কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনি ঢাকায় কিংবা পঞ্চগড়ে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে চাঁদপুরের ইলিশ খাচ্ছেন, যেকোন সময় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোন অঞ্চলে কৃষকের ফলানো ক্ষেতের সবজি হাতের নাগালে পাচ্ছেন, আবার কেউ হয়তো সাতক্ষীরার নিঝুম কোন গ্রামে বসে যে নকশীকাঁথা বুনছেন সেটি দিয়েই শীতের রাতে সুখনিদ্রা দিচ্ছেন রংপুর, দিনাজপুরের কোন মানুষ। টাঙ্গাইল, পাবনা, সিরাজগঞ্জে তৈরি হচ্ছে নানা রকমের শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি যা চাইলেই আমরা নিকটস্থ মার্কেট থেকে কিনতে পারছি। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে।
এতকিছু আমরা যখন-তখন হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছি, ভেবেছেন কখনো?
আমাদের চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধানটুকু কমিয়ে দিয়েছে আমাদের পরিবহন খাত। আর পণ্য পরিবহনের অন্যতম বাহন হল ট্রাক। তাই চলুন এই উপকারী বাহনের উদ্ভাবন সম্পর্কে কিছু তথ্য আজ জেনে নেই।
প্রথম মোটরচালিত ট্রাক উদ্ভাবন করেছিলেন একজন জার্মান ইঞ্জিনিয়ার? তিনি হলেন, জার্মান অটোমোটিভের পথিকৃৎ গটলিয়েব ডেইমলার। মোটরচালিত যান তৈরির প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। আর সেই কাজটি তা করতে সক্ষম হয়েছিল সফলভাবে।
শুরুর দিকে তৈরি বাণিজ্যিক যানবাহনগুলো দেখতে অনেকটা ঘোড়ার গাড়ির মত ছিল। পরে ইঞ্জিন জুড়ে দেওয়ার পর সেটার চেহারায় পরিবর্তন আসে। গটলিয়েব ডেইমলারের প্রথম ট্রাকটি ১.৫ টন ভর বহন করতে পারত। একটি ৪ অশ্বক্ষমতার ইঞ্জিন ২টি সিলিন্ডার ফিনিক্স দ্বারা চালিত ছিল। এর প্রায় ১০ বছর পরে, ডেইমলার একটি ১০ অশ্বশক্তির ট্রাক বাজারজাত করেন। যা পণ্য পরিবহনের সময় প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭ মাইল বেগে চলতে পারতো।
১৮৯৯ সালে উইন্টন মোটর ক্যারিয়েজ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার উইন্টন প্রথম ১৮ হুইলার আবিষ্কার করেছিলেন। উইনটন তার এই সেমি ট্রাকটি তৈরি করেন মূলত ভারী পণ্য পরিবহনের জন্য। উইন্টন মোটর ক্যারিয়েজ তৎকালীন সময়ে পুরো আমেরিকাতে গ্রাহকদের কাছে সফলভাবে এই সেমি ট্রাক বিক্রি করেছিল।
ম্যাক ব্রাদার্স ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত করে ম্যাক ট্রাকস। আমেরিকান এই কোম্পানি মার্কেটে প্রথম যারা স্বয়ংক্রিয় স্টার্টার ব্যবহার করেছিল। ফলে হাত নিয়ন্ত্রিত স্টার্টার ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। ম্যাক ট্রাকস ১৯২০ সালের দিকে একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছিল। তাদের ট্রাক শক্ত এবং নির্ভরযোগ্য যান হিসাবে বেশ খ্যাতিও অর্জন করেছিল।
পাঠক জেনে অবাক হবেন যে সেই ১৯১৪ সালেই প্রথম “সেমি ট্রেলার” আবিষ্কৃত হয়েছিল!
ফোর্ড গাড়ির পেছনে নৌকা চালানোর মতো করে আগস্ট ফ্রুহাউফ এমন ট্রেলার তৈরি করেছিলেন যা সে সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন সময়ে আমেরিকাতে ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত এই ট্রেলার। ফ্রুহাউফ ট্রেলার আজও বেস সফলভাবে ব্যবসা করছে।
১৯১৮ সালে শেভ্রোলেট কোম্পানি, পিকআপ ট্রাকের উত্পাদন শুরু করে। তবে মজার ব্যাপার হল, তারা গাড়ির ফ্রেম নির্মান করলেও এই গাড়ির কোন রিয়ার-এন্ড ছিল না। ফলে ক্রেতাদের নিজস্ব রিয়ার-এন্ড সেট করে নিতে হত। শেভ্রোলেট ১৯৩১ সালের পরে গ্রাহকদের এই সুবিধা প্রদান করা শুরু করে।
১৯২৫ সালে আটোমোবাইল জায়েন্ট ফোর্ড তাদের পিক-আপ মডেল টি-রানাবাউট উৎপাদন শুরু করে।
এরপর সময়ের সাথে সাথে ট্রাকের মডেলে পরিবর্তন আসতে থাকে। ১৯৩৯ সালে পিটারবিল্ট এমন একটি ট্রাক উদ্ভাবন করেন যা দিয়ে খুব সহজেই গাছের ভারি গুড়ি টানা যায়। ফলে সড়ক পথে প্রথমবারের মতো গাছের গুড়ি পরিবহন করা শুরু হয়েছি যা পূর্বে নদীপথ ছাড়া সম্ভব ছিল না।
জাপানিজ হিনো মটরস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ সালে যা বর্তমানে একটি বহুজাতিক জায়েন্ট কোম্পানি।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অশোক লেল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। বর্তমানে এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক মটরগাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশে একটা সময় প্রচুর বেডফোর্ডের ট্রাক চলতো। এখন টাটা, অশোক লেল্যান্ড, হিনোর ট্রাকের চাহিদা বেশি।
যুগের সাথে সাথে ও কালের বিবর্তনে ট্রাকে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি ট্রাককে আরও বেশি ওজন বহন করার সক্ষম করে তুলেছে এবং দ্রুতগতিতে ছুটে চলার সুযোগও করে দিয়েছে। অবাক ব্যাপার হল প্রযুক্তি বর্তমানে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাকে করেছে ডিজিটাল। ট্রাক এখন আর স্ট্যান্ডে গিয়ে খুঁজতে হয় না, মোবাইলেই ট্রাক ভাড়া করা যায়। অন্যদিকে ট্রাক মালিকরাও ঘরে বসেই ট্রিপ পেয়ে যান। জিম ডিজিটাল ট্রাক তেমনই একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। হাতের কাছে ট্রাক পেতে জিম তৈরি করছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক।
ট্রাকের সাথে প্রযুক্তির এই দারুণ রসায়ন মানুষের জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করে চলেছে প্রতিনিয়ত।